ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি অতি দ্রুত সম্পন্ন হয়। দুটি পদ্ধতিতে জনন ক্রিয়া ঘটে- অযৌন ও যৌন
১. অযৌন জনন (Asexual Reproduction) : (গ্যামেট উৎপাদন ও এদের মিলন ছাড়াই যে জনন ঘটে তার নাম অযৌন জনন । এ ধরনের জনন পদ্ধতিতে একটিমাত্র মাতৃদেহ থেকেই নতুন জীবের সৃষ্টি হয়। ব্যাকটেরিয়াতে নানা ধরনের অযৌন জনন সম্পন্ন হলেও দ্বিভাজন পদ্ধতিই এর সংখ্যাবৃদ্ধির প্রধান উপায়। নিচে বিভিন্ন ধরনের অযৌন জনন পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।
ক. দ্বিভাজন (Binary fission) : এ ধরনের জননের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার কোষদেহটি সরাসরি (ক্রমাগত ধীর প্রক্রিয়ায়) বিভাজিত হয়ে হুবুহু একই রকমের দুটি অপত্য কোষে পরিণত হয় । প্রতিটি অপত্য কোষ পরিণত হয়ে পুনরায় একই ভাবে বিভাজিত হয়ে অসংখ্য অপত্য কোষের সৃষ্টি করে। এভাবে ক্রমাগত বিভাজন পদ্ধতির দ্বারা স্বল্প সময়ে ব্যাকটেরিয়া কোষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রক্রিয়াটি নিম্নবর্ণিত উপায়ে সম্পন্ন হয়।
১. প্রক্রিয়ার শুরুতে ব্যাকটেরিয়াল DNA ব্যাকটেরিয়া কোষের দুই প্রান্তের মাঝামাঝি অবস্থান নেয় এবং কোষঝিল্লির (কখনও কখনও একটি মেসোজোম) সাথে যুক্ত হয়।
২. কোষঝিল্লির সাথে যুক্ত অবস্থায় DNA অণুর প্রতিলিপন বা রেপ্লিকেশন ঘটে ফলে দুটি অপত্য DNA অণু সৃষ্টি হয় ।
৩. কোষটির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং কোষের দুই প্রান্তের মাঝখানে নতুন কোষপ্রাচীর ও কোষঝিল্লির বৃদ্ধি সংঘটিত হয় ।
৪. কোষপ্রাচীর ও কোষঝিল্লি লম্বায় বৃদ্ধির কারণে অপত্য DNA অণুদুটি দুই দিকে পৃথক হয়ে যায়।
৫. দুই DNA অণুর মাঝখানে বৃদ্ধিরত কোষপ্রাচীর ও কোষঝিল্লি ক্রমশ ভেতরের দিকে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ভেতরে প্রবেশ করে ছেপ্রাচীর (septum) নির্মাণ করে।
৬. কোষের সাইটোপ্লাজম ধীরে ধীরে দুভাগে বিভক্ত হয়ে এবং গোলাকার DNA-তন্ত্রী (নিউক্লিওয়েড) পরিবেষ্টিত হয়ে দুটি পৃথক অপত্য কোষে পরিণত হয়।
৭. নতুন সৃষ্ট অপত্য কোষদুটি পরস্পর হতে পৃথক হয়ে যায়, অনুকূল পরিবেশে বৃদ্ধি পেয়ে মাতৃকোষের সমান আকার ধারণ করে এবং পুনরায় দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
খ. মুকুলোদগম (Budding) : এ প্রক্রিয়ায় মাতৃকোষের একাংশ বিবর্ধিত হয়ে মুকুল (bud) গঠন করে এবং দেহের DNA টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ (DNA) মুকুলের মধ্যে প্রবেশ করে। ওই মুকুলটি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে বড় হয় এবং পরিণত মুকুল মাতৃকোষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপত্য ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়।
গ. খন্ডায়ন (Fragmentation) : এ প্রক্রিয়া সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়া যেমন-স্ট্রেপটোমাইসিস প্রজাতিতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়ার দেহ বিভাজনের মাধ্যমে বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে অসংখ্য দণ্ডাকার ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে ।
ঘ. কনিডিয়া (Conidia) : সূত্রাকার স্ট্রেপটোমাইসিস ব্যাকটেরিয়া স্পোরের মতো কতগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধ কনিডিয়া বা কুনিডিওস্পোর গঠন করে বংশ বৃদ্ধি করে। কনিডিয়া দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় অল্প সময়ে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয়। (সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়ার সচল কনিডিয়াকে গোনিডিয়া (gonidia) বলে।)গনিডিয়া (Gonidia) : কতগুলো ব্যাকটেরিয়ার প্রোটোপ্লাজম খন্ডিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফ্ল্যাজেলাযুক্ত গনিডিয়া বা গনিডিওস্পোর উৎপন্ন করে। মাতৃ-কোষে প্রাচীর বিদীর্ণ হয়ে গনিডিয়াগুলো বাইরে বেরিয়ে এসে অপত্য ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে। Leucothris- জাতীয় সূত্রাকার ব্যাকটেরিয়া এভাবে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায় ।
চ. এন্ডোস্পোর (Endospore) : প্রতিকূল পরিবেশে উপযুক্ত খাদ্যের অভাব ঘটলে ব্যাকটেরিয়া অন্তরেণু বা এন্ডোস্পোর সৃষ্টি করে বংশের বিস্তার ঘটায়। এ সময় ব্যাকটেরিয়া কোষের প্রোটোপ্লাস্ট সংকুচিত হয়ে গোল বা প্রতিকূ ডিম্বাকার ধারণ করে। এর চারদিকে একটি পুরু আবরণ তৈরি হলে তাকে এণ্ডোম্পোর বলে।এণ্ডোস্পোরের সাহায্যে ব্যাকটেরিয়াম কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি হয় না । তাই একে বংশবৃদ্ধির উপায় হিসেবে বিবেচনা না করে বরং প্রতিকূলতা প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে রেস্টিং স্পোর (resting spore) নামে অবকাশকালীন স্পোর হিসেবে গণ করা হয়। সাধারণত Bacillaceae গোত্রের ব্যাকটেরিয়া এন্ডোস্পোর উৎপন্ন করে থাকে।
যৌন জনন (Sexual reproduction) :
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে জানা গেল যে ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের আদি প্রক্রিয়ার যৌন জননে অংশ নেয়। এক্ষেত্রে কোনো গ্যামেটের সৃষ্টি হয় না, দুটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে শুধু জিনগত পদার্থের বিনিময় ঘটে। তাই এ প্রক্রিয়াকে জিনগত পুনর্বিন্যাস বা জেনেটিক রিকম্বিনেশন (genetic recombination) বলে ।
E. coli নিয়ে গবেষণাকালে এ ঘটনা আবিষ্কৃত হয়েছে।ইলেকট্রণ অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে দেখা যায় যে উল্লিখিত প্রক্রিয়া ঘটার সময় দুটি ব্যাকটেরিয়া প্রত্যক্ষ সংযুক্তি কনজুগেশন (conjugation) এর মাধ্যমে মিলিত হয়। যে ব্যাকটেরিয়াম দাতা (বা পুরুষ) হিসেবে ভূমিকা পালন করে তার দেহে বিশেষ ধরনের জিনবাহী পাইলাস থাকে। এর নাম F pilus (Fertility pilus)। পাইলাস ফাঁপা সূত্রের মতো । এর ভিতর দিয়ে দাতার DNA গ্রহীতার (-) দেহে প্রবেশ করে। কিন্তু দাতা কোষের নিউক্লিও পদার্থ সম্পূর্ণরূপে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বেই কোষ দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে গ্রহীতা কোষটি দাতা কোষের নিউক্লিও-পদার্থের অংশবিশেষ লাভ করে একটি আংশিক বা অসম্পূর্ণ জাইগোট-এ পরিণত হয়। এ ধরনের জাইগোট মেরোজাইগোট (merozygote) নামে পরিচিত। সংশ্লেষের শেষে দাতা কোষটি বিনষ্ট হয়।
মেরোজাইগোটের অভ্যন্তরে দাতা কোষ ও গ্রহীতা কোষের নিউক্লিও-পদার্থগুলোর বিনিময় ও পুনর্বিন্যাস ঘটে । ফলে নতুনভাবে বিন্যস্ত নিউক্লিওয়েডের সৃষ্টি হয়। অতঃপর মেরোজাইগোটটি স্বাভাবিক দ্বিভাজন প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়। ফলে অপত্য কোষগুলোতে মিশ্র চরিত্রের (অর্থাৎ যৌন জননে অংশ গ্রহণকারী দাতা ও গ্রহীতা কোষের মিশ্র চরিত্র) উদ্ভব ঘটে ।
ব্যাকটেরিয়ার যৌন জনন প্রকৃত যৌন জনন নয়। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এ ধরনের মিলনকে চারিত্রিক গুণাবলির বিনিময় ও পুনর্বিন্যাস নামে আখ্যায়িত করার পক্ষপাতী।
আরও দেখুন...